সূচক কতটা বাজার নির্দেশক?

সূচক কতটা বাজার নির্দেশক?

কৌশলগত বিনিয়োগকারী শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের কারিগরি সহায়তায় সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে নতুন একটি সূচক চালু করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। সিএনআই-ডিএসই সিলেক্ট ইনডেক্স (সিডিএসইটি) নামের সূচকটি নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ডিএসইর ওয়েবসাইটের হোমপেজে চালু করা হবে। নতুন সূচকটি তৈরি ও উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল শেনঝেন সিকিউরিটিজ ইনফরমেশন কোম্পানি লিমিটেড। সূচকটির ভিত্তি তারিখ ধরা হয়েছে ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর। ভিত্তিমূল্য (বেজ ভ্যালু) ধরা হয়েছে ১ হাজার পয়েন্ট। সূচকটিতে বড়, মাঝারি ও স্বল্প মূলধনি কোম্পানি—এ তিন ক্যাটাগরি থাকবে।

সূচকটি চালুর পেছনে উদ্দেশ্য, বর্তমানে গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মা, বিএটিবিসির মতো বড় মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদরে উত্থান-পতন হলে ডিএসইর ব্রড ইনডেক্সে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। কিন্তু নতুন সূচকটি চালু হলে বড়, মাঝারি ও স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলো আলাদা ক্যাটাগরিতে থাকবে। এতে সূচকে এককভাবে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানির প্রভাব কমে আসবে। এছাড়া বিনিয়োগকারীরা এ সূচকের মাধ্যমে একনজরে বৃহৎ, মধ্যম ও স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদরের হ্রাস-বৃদ্ধি দেখে নিতে পারবেন। এতে বিশ্ববাজারে ডিএসই সূচকের ব্র্যান্ডিং হবে এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এ দেশের পুঁজিবাজারে আরো বেশি বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন।

কিন্তু কোনো একটি সূচক বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে? সূচক দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কতটা যুক্তিযুক্ত? সার্বিকভাবে পুঁজিবাজারে সূচকের ভূমিকা কেমন? বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আগে জেনে নেয়া যাক শেয়ার সূচকের খুঁটিনাটি কিছু বিষয়।

সূচকে বাজারের হালচাল

একজন বিনিয়োগকারী বা বাজার বিশ্লেষক সাধারণত সূচকের মাধ্যমেই বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করেন। সূচকে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেলে বাজার পরিস্থিতি ইতিবাচক এবং নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেলে বাজার পরিস্থিতি নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্সের কথাই ধরা যাক। এক বছর ধরে টানা নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যে রয়েছে সূচকটি। এ থেকে সহজেই নেতিবাচক বাজার পরিস্থিতির বিষয়টি অনুমান করা যায়।

শেয়ারবাজারে আমরা যেসব সূচক দেখতে পাই, সেগুলো হলো মূলত বাজারে বিদ্যমান শেয়ারের অনুমাননির্ভর পোর্টফোলিও। সূচকের যে মান আমরা দেখতে পাই, তা নানাভাবে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সূচক নির্ণয়ের প্রাথমিক ভিত্তি হলো ভারিত গড়। পোর্টফোলিওতে বিদ্যমান শেয়ারের মানের ভারিত গড়ের মাধ্যমে সূচকের মান নির্ণয় করা হয়।


প্রতিটি সূচক হিসাবের রয়েছে ভিন্ন পদ্ধতি। সাধারণত সূচকের হিসাব ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে ইনডেক্স প্রোভাইডার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শেয়ারদর বা বাজার মূলধনের ওপর ভিত্তি করে সূচক হিসাব করা হয়। একটি সূচকে অন্তর্ভুক্ত শেয়ারগুলোর দামের ভারিত গড় বা বাজার মূলধনের ভারিত গড়ের মাধ্যমে বেশির ভাগ সূচকের মান নির্ণয় করা হয়ে থাকে। কোনো একটি শেয়ারের দর অনেক বেশি বেড়ে গেলে শেয়ারদরনির্ভর সূচকে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে একটি কোম্পানির বাজার মূলধন অনেক বেশি হলে, এটির দরপতনের সঙ্গে সঙ্গে গোটা সূচক নিম্নমুখী হয়ে পড়ে। ডিএসইএক্সের অন্তর্ভুক্ত গ্রামীণফোনের শেয়ারটিকে এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে। গ্রামীণফোনের শেয়ারে আংশিক উত্থান-পতন হলে ডিএসইএক্সে এর সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে।

সাধারণত বিনিয়োগকারীরা সূচকে সরাসরি বিনিয়োগ করতে পারেন না। কিন্তু এগুলোর ওঠানামার মধ্য দিয়ে বাজার সম্পর্কে তাদের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়।

সূচক: দেশে-বিদেশে

বিনিয়োগকারীরা সাধারণত বাজার পরিস্থিতি বোঝার জন্য বিভিন্ন সূচক অনুসরণ করে থাকেন। দেশের বিনিয়োগকারীরা ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স, ব্লু-চিপ সূচক ডিএস৩০ বা শরিয়াহ সূচক ডিএসইএসের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করেন। এছাড়া চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান সূচক সিএসসিএক্স, নির্বাচিত কোম্পানির সিএসই৩০ ও শরিয়াহ সূচক সিএসআইয়ের মতো সূচকগুলোও অনুসরণ করে থাকেন বিনিয়োগকারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার পরিস্থিতি বুঝতে বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করেন ডাও জোনস, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ও নাসডাক কম্পোজিটের মতো সূচকগুলো। ইউরোপের শেয়ারবাজারে রয়েছে যুক্তরাজ্যের এফটিএসই-১০০, জার্মানির ডিএএক্স, ফ্রান্সের সিএসি-৪০ সূচক। এশিয়ার শীর্ষ সূচকগুলোর মধ্যে রয়েছে জাপানের নিক্কেই-২২৫, হংকংয়ের হ্যাং সেং, চীনের সাংহাই কম্পোজিট ও ভারতের এসঅ্যান্ডপি বিএসই সেনসেক্স।


ডিএসইএক্স ও ডিএস৩০ সূচক দুটি ‘ডিএসই বাংলাদেশ ইনডেক্স মেথডোলজি’ অনুযায়ী নকশা ও উন্নয়ন করেছে এসঅ্যান্ডপি ডাও জোনস ইনডাইসেস। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে এ ইনডেক্স দুটি চালু হয়েছে। দেশের শেয়ারবাজারের মোট বাজার মূলধনের ৯৭ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে ডিএসইর ব্রড ইনডেক্স ডিএসইএক্স। অন্যদিকে শীর্ষ ৩০টি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে চালু করা হয় ডিএস৩০ সূচক। শেয়ারবাজারের মোট বাজার মূলধনের ৫১ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে এ সূচকটি।

ডিএসইর সূচকগুলোর মান হিসাব করা হয়েছে বাজার মূলধনের ওপর ভিত্তি করে। যেসব কোম্পানির ফ্লোট-অ্যাডজাস্টেড বাজার মূলধন ৫০ কোটি টাকার বেশি সেগুলোকে ডিএস৩০-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে ডিএসইএক্স সূচকে থাকতে হলে একটি কোম্পানির ফ্লোট-অ্যাডজাস্টেড বাজার মূলধন হতে হবে ১০ কোটি টাকার বেশি।

সূচক কথা কয়

লেখার শুরুতেই ডিএসইর নতুন সূচক চালু করার অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীরা যেন একনজরে বৃহৎ, মধ্যম ও স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদরের হালচাল সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। আসলে প্রায় সব সূচকের মূল উদ্দেশ্যই তাই। মূলধনি বাজার বিশ্লেষণের সময় ফিন্যান্সিয়াল মিডিয়াগুলো প্রায়ই ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ, এসঅ্যান্ডপি ৫০০, নাসডাক কম্পোজিটের মতো সূচকগুলোর কথা উল্লেখ করে। আসলে সূচকগুলো হলো বাজারের ‘স্পন্দন’। এগুলো বিনিয়োগকারীদের সামনে বাজারের হালচাল তুলে ধরে।


কিন্তু সূচকের একটি সংখ্যা কি পুরো বাজারকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম? প্রকৃতপক্ষে একটি সূচক সম্পূর্ণ বাজারের প্রতিনিধিত্ব করে না। বরং তা বাজারের একটি নির্দিষ্ট অংশের চালচিত্র তুলে ধরে। কারণ একটি সূচক তৈরি হয় বাজারের নির্দিষ্ট কোনো সেক্টর বা ক্যাটাগরির বিভিন্ন শেয়ারকে নিয়ে। ফলে একটি সূচকের উত্থান-পতন দিয়ে পুরো বাজারের স্বরূপ বিবেচনা করাটা কঠিন।

দেখা গেল কোনো একদিন বাজারের শীর্ষ তিন সূচকই পড়ে গেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওইদিন সূচকগুলোর আওতাধীন সব শেয়ারই দর হারিয়েছে। ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সূচক পতনমুখী থাকলেও ওইদিন কিছু শেয়ার ঠিকই বিনিয়োগকারীদের ভালো রিটার্ন দিয়েছে। অর্থাৎ সূচক দেখে বাজার সম্পর্কে ধারণা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু কোন শেয়ার কখন ছেড়ে দিতে হবে আর কখন ধরে রাখতে হবে, সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে নির্দিষ্ট ওই শেয়ারের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতেই, সূচকের ভিত্তিতে নয়।

আরেকটি বিষয়, সূচক প্রকৃত লেনদেনের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এর ওঠানামায় বিনিয়োগকারীদের আবেগের (ইনভেস্টর ফিলিং) প্রভাব খুব সামান্যই। যেসব বিনিয়োগকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভালো বা মন্দ খবরের প্রত্যাশায় থাকেন, তাদের জন্য সূচক খুব সামান্যই অর্থবহ। এছাড়া পরিসংখ্যানগত প্রয়োজনীয়তা মেটানো অর্থাৎ হিস্টোরিক্যাল পারসপেক্টিভে সূচক একটি কার্যকর হাতিয়ার। বাজারের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ বা গবেষণায় তা কাজে লাগে। কিন্তু এটি কোনো ফোরকাস্টিং ভেহিকল নয়। অর্থাৎ ভবিষ্যতে বাজার কেমন হবে, তা জানানো সূচকের কাজ নয়।

কিছু সূচক রয়েছে, যেগুলো কেবল বৃহৎ মূলধনি কোম্পানি নিয়ে গড়া। ফলে এসব কোম্পানির প্রথম সারির দু-একটির যদি একদিন খারাপ যায়, তাহলে পুরো সূচকই নিম্নমুখী হতে পারে। ফলে সার্বিকভাবে কেবল সূচক দেখে সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব একটা যুক্তসংগত নয়।

তাহলে কি সূচক বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো কাজের না? একেবারেই তা নয়। কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে বটে, তবে সূচক বিনিয়োগকারীদের কাজেও লাগে বেশ। এটি বাজারের ট্রেন্ড ও ইনভেস্টিং প্যাটার্নের পরিবর্তন তুলে ধরে। কখন কোন খাতের শেয়ারে বিনিয়োগ করলে ভালো রিটার্ন পাওয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে এখান থেকে। সূচক যদিও বাজারধারার পুরো চিত্র তুলে ধরতে পারে না, তবুও একটা ‘স্ন্যাপশট’ ঠিকই দেয়।

একটি সূচক কত পয়েন্টে অবস্থান করছে, তা জানার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সূচকটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কতখানি কমেছে বা বেড়েছে—তা জানা। কারণ এতে সূচকের পারফরম্যান্স সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যায়।

কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ধরা যাক একটি স্টক এক্সচেঞ্জে ৫০০ শেয়ার রয়েছে। এক্ষেত্রে একজন বিনিয়োগকারীর পক্ষে আলাদাভাবে প্রতিটি শেয়ার প্রতিদিন মনিটরিং করা সম্ভব নয়। তাহলে তিনি কী করবেন? এক. তিনি যদি স্পেকুলেটিভ ট্রেডার হন, তাহলে অন্যদের কাছ থেকে শোনা খবর বা গুজবের ভিত্তিতে শেয়ার লেনদেন করবেন। দুই. আর যদি তিনি হন বিশ্লেষণধর্মী বিনিয়োগকারী, তবে ভালো শেয়ার খুঁজে সেগুলো মনিটরিং করবেন। আর এর জন্য সূচকের চেয়ে ভালো ইনস্ট্রুমেন্ট আর কী হতে পারে?

নির্দিষ্ট ক্যাটাগরি বা খাতভিত্তিক শেয়ার মনিটরিংয়ের জন্য সূচক আসলেই ভালো একটি নির্দেশক। এর মাধ্যমে একজন বিনিয়োগকারী নির্দিষ্ট খাতের শেয়ারগুলোর পারফরম্যান্স সম্পর্কে চটজলদি ধারণা পেতে পারেন। প্রাতিষ্ঠানিক ও বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের জন্যও সূচক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

সার্বিকভাবে পুঁজিবাজারের জন্যও সূচক বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্টক এক্সচেঞ্জের আওতায় থাকা বিভিন্ন সূচকের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে কোন খাতে আরো বেশি নজর দেয়া দরকার, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সঠিক সময়ে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা না হলে তা পুরো পুঁজিবাজারের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ